রচনা

রচনা: মানব কল্যাণে বিজ্ঞান/প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান(২০পয়েন্ট)

               মানব কল্যাণে বিজ্ঞান
অথবা
প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান

ভূমিকা :  বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে অভাবনীয় গতি, সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে করেছে দুততর ও বহুমাত্রিক। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের জাদুকরী স্পর্শে মানবজীবনের সর্বত্র এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সর্বক্ষেত্রে আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে বিজ্ঞানের অব্যাহত জয়যাত্রা। মানব কল্যাণে বিজ্ঞানের অবদান যে কত ব্যাপক তা প্রতিদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করা যায়। বিজ্ঞানের কল্যাণে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে এসেছে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।

বিজ্ঞান কথাটির অর্থ :  বিজ্ঞান’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Science’ এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Scio’ থেকে, যার অর্থ জানা বা শিক্ষা লাভ করা। আভিধানিক অর্থে বিশেষ জ্ঞানই হলাে বিজ্ঞান। মনীষী স্পোরের মতে, বিজ্ঞান হলাে সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ জ্ঞান। অনুসন্ধিৎসু মানুষের বস্তুজগৎ সম্পর্কে ধারণা এবং বিচিত্র কৌশলে তার উপর আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা থেকেই উদ্ভব ঘটেছে বিজ্ঞানের। এটি হয়েছে মানুষেরই প্রয়ােজনে, তার অভাব মেটানাের তাড়না থেকে। এভাবে সভ্যতার বিকাশের সহায়ক শক্তি হয়ে উঠার মাধ্যমে বিজ্ঞান ক্রমেই মানুষের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে।

জীবন ও বিজ্ঞান :  প্রয়ােজনই উদ্ভাবনের প্রেরণা জোগায়। মানুষের অভাববােধ থেকে বিশেষ জ্ঞান হিসেবে বিজ্ঞানের উৎপত্তি। তাই জীবনের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক যেমন পুরােনাে, তেমনি নিবিড়। মানুষের অনুসন্ধিৎসা, জিজ্ঞাসা ও আগ্রহ থেকে বিজ্ঞানের বিচিত্র বিকাশ। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সংস্কার, বিশ্বাস ওপ্রবণতা বদলে যাচ্ছে। আজ বিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে আমরা সব কিছু যাচাই করে দেখতে চাই, প্রমাণ জানতে চাই অনেক কিছুর। এ জিজ্ঞাসা ও তর্কের প্রবৃত্তি আমাদের বৈজ্ঞানিক পরিবেশের ফল। সুতরাং বিজ্ঞান সম্পর্কে আমরা যতই অজ্ঞ হই না কেন, বিজ্ঞানের প্রভাব আমাদের জীবনের মর্মমূলে প্রবেশ করেছে।

বিজ্ঞানের গুরুত্ব :  মানবসমাজের যে দিকেই দৃষ্টিপাত করা যায়, শুধু বিজ্ঞানের মহিমাই
স্পষ্ট হয়ে উঠে। বিজ্ঞানের বলে মানুষ জল-স্থল, অন্তরীক্ষ জয় করেছে; সংকট নিরসন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের বহু অভাবনীয় কৌশল আবিষ্কার করেছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানের গৌরবময় অবদান বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে আছে এবং মানবজীবনের উপর এর সুগভীর প্রভাব পড়ছে। মানবজীবনকে অফুরন্ত সুখে পরিপূর্ণ করে তােলার সাধনায় সদা নিয়ােজিত বিজ্ঞান তার বিস্ময়কর আবিষ্কার চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত। এ সাধনা যেমন ক্রমাগতভাবে
চলছে, তেমনি তার কল্যাণকর সুফলও নিবেদিত হচ্ছে মানুষের সেবায়। বিজ্ঞানের কর্মসাধনার পরিণতি হচ্ছে আধুনিক সভ্যতা। বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ আজ আকাশ ও পাতালকে সাজিয়েছে নিজের পরিকল্পনা অনুসারে। তারা জীবনকে জয় করে মৃত্যুকে পদানত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে নব নব কৌশল ও প্রকরণ প্রবর্তনের মাধ্যমে এ জগতে বিজ্ঞান এনেছে যুগান্তর; দূরকে করেছে আপন আর জীবনকে করেছে সহজ।

আরও দেখুন:- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুচ্ছেদ রচনা।

চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান :  চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যে আজ মানুষ অকালমৃত্যুর কবল
থেকে রক্ষা পেয়েছে। কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্মা ইত্যাদি মরণব্যাধির সু-চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে আবিষ্কৃত হয়েছে। উন্নত মানের ওষুধ, অস্ত্রোপচার ব্যবস্থা, এক্সরে, আলট্রাভায়ােলেটরে, অণুবীক্ষণ যন্ত্র ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এসেছে। এক আমূল পরিবর্তন। উন্নত চিকিৎসা সেবার ফলে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের গড় আয়ু কম্পিউটারকেন্দ্রিক টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে পৃথিবীরযে কোনাে প্রান্ত থেকে যে কোনাে ব্যক্তি উন্নত দেশের ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করে সুস্থ থাকতে পারছে। আবিষ্কৃত হয়েছে কৃত্রিম হৃদযন্ত্র ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। অবলীলায় করা হচ্ছে। ওপেন হার্ট সার্জারি, শরীর না কেটে বাইপাস সার্জারি, প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে একজনের অঙ্গ অন্যজনের শরীরে। বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষের জেনেটিক স্বরূপ উদ্ঘাটনেরদ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বিজ্ঞানীরা, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে বয়ে আনবে যুগান্তকারী বিপ্লব।

কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান :  আধুনিক বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রেও অশেষ উন্নতি সাধন করেছে।
প্রাচীন ভোঁতা লাঙলের পরিবর্তে আজ ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত মানের কলের লাঙল ও ট্রাক্টর।
ফসলের উৎপাদন ও মান বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক রাসায়নিক সার। কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত মানের কীটনাশক। প্রকৃতির দয়ার উপর নির্ভরশীল না হয়ে গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে পানি সেচের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গবেষণার মাধ্যমে খরা, শীত ও লবণাক্ততা-সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যার ফলে ধান, গমসহ সকল প্রকার খাদ্যশস্যের উৎপাদন বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত জাতের মাছ, গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি উদ্ভাবনের ফলে ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে অভাবনীয় হারে। এভাবে বিজ্ঞান আজউর্বরতা দিয়ে ক্ষয়িষ্ণু বসুধাকে শস্যবতী ও ফলবান করে ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে হাসি
ফুটিয়েছে।

যােগাযােগক্ষেত্রে বিজ্ঞান :  আধুনিক যােগাযােগ ব্যবস্থার পুরােটাই বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বুলেট ট্রেন, আধুনিক কনকর্ড বিমান, মাটির তলায় ধাবমান টিউব রেল সবই বিজ্ঞানের অবদান। বিজ্ঞানের অবদানেই আজ আমরা এরােপ্লেনে চড়ে শূন্যাকাশে শত শত মাইল পাড়ি দিচ্ছি, যা একসময় ছিল অচিন্তনীয়। বিজ্ঞানের আরেক বিস্ময়কর আবিষ্কার মােবাইল ফোন। এখন আমরা হাতের মােবাইল টিপে মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর যে কোনাে প্রান্তে অবস্থিত ব্যক্তির সাথে কথা, ছবি ও ভিডিও আদান-প্রদান করতে পারি। সারা বিশ্বের প্রতি মুহূর্তের সংবাদও এখন আমরা মােবাইলে পাই। যা বিজ্ঞানেরই
আশীর্বাদ।

শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞান :  একদা মানুষ জীবনের প্রয়ােজনীয় উপকরণ সংগ্রহ ও উৎপাদনে
কায়িক শ্রমের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। এতে মানুষের কাজ করতে অধিক সময় ও শ্রমের প্রয়ােজন হতাে। কিন্তু তুলনায় কাজ হতাে কম। বিজ্ঞানের কল্যাণে শিল্পবিপ্লবের ফলে কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে, বেড়েছে উৎপাদন, লাঘব হয়েছে মানুষের কায়িক শ্রম। উৎপাদনের সর্বক্ষেত্রে আজ বিরাজ করছে যন্ত্রের আধিপত্য। ফলে মানুষ পেয়েছে স্বস্তি ও আয়াসপূর্ণ জীবন। শত মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় যা আগে করার চেষ্টা করা হতাে এখন তা যন্ত্রের বােতাম টিপে মুহূর্তের মধ্যে সম্পন্ন করা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে
মানুষের কর্মের স্থানটিও দখল করে নিচ্ছে বৈজ্ঞানিক রােবট।

প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান : বিজ্ঞানের কল্যাণস্পর্শে প্রকৃতির অনেক ধ্বংসাত্মক দিককে মানুষ কল্যাণকর দিকে পরিবর্তিত করতে সক্ষম হয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস, নদীশাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানুষ আজ বিজ্ঞানের বদৌলতে অভূতপূর্ব সাফল্যঅর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উইন্ডমিলের মাধ্যমে মানুষবিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু করছে। মােটকথা, বিজ্ঞানের কল্যাণেএক সময়ের ভয়ংকরী প্রকৃতি আজ শুভংকরী প্রেয়সীতে রূপান্তরিত হয়েছে।

দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান :  দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশ। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিক বাতি ও পাখা, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ, বৈদ্যুতিক ইস্ত্রি ও বৈদ্যুতিক হিটার ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে আমাদের। জীবনযাত্রা অত্যন্ত সহজ ও আরামদায়ক হয়ে উঠেছে। অফিস-আদালতে নিত্য ব্যবহৃত হচ্ছে কম্পিউটার, ফটোস্ট্যাট মেশিন, টেলেক্স, ফ্যাক্স ইত্যাদি যন্ত্রপাতি। এমনিভাবে বিজ্ঞান মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কত রকম প্রয়ােজন যে মেটাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই।

বিজ্ঞানের ক্ষতিকর দিক : বিজ্ঞান একদিকে যেমন মানুষের অশেষ কল্যাণ সাধন করে আসছে, অন্যদিকে তেমনি এনেছে বিভীষিকা। যন্ত্রের উপর নির্ভর করতে করতে মানুষের জীবনে এসেছে যন্ত্রনির্ভরতা, কর্মবিমুখতা। এটি অনেক ক্ষেত্রে বেকার সমস্যাবাড়িয়ে তুলছে। ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মতাে আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে অনেক ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ ঘটছে বিজাতীয় অপসংস্কৃতির। এতে করে যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার আজ মানব সভ্যতাকেধ্বংসের মুখােমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। ডিনামাইট, বােমারু বিমান, ট্যাঙ্ক, সাবমেরিন ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে মানবজীবনে বিজ্ঞান অভিশাপে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বােমা নিক্ষেপের ফলে জাপানের হিরােশিমা ও
নাগাসাকি শহরের ধ্বংসযজ্ঞ তারই বাস্তব প্রমাণ।

উপসংহার :  বর্তমান সভ্যতা বিজ্ঞানের অবদান। মানব জাতি বর্তমানে প্রতি মুহূর্তে প্রতি পদক্ষেপে বিজ্ঞানের কাছে দায়বদ্ধ। তবে কাটা ছাড়া যেমন গােলাপ হয় না, তেমনিবিজ্ঞানের সব আবিষ্কারই সভ্যতার জন্য মঙ্গলজনক নয়। বিজ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে অদূর ভবিষ্যতে মানব সভ্যতা সমৃদ্ধি ও উন্নতির চরম শিখরে পৌছে যাবে।

Back to top button