জীবনী

কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী (সকল তথ্য জানুন)

হ্যালো বন্ধুর, আশা করি সবাই ভালো আছেন। আজকে আপনাদের কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

   কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী বিস্তারিত

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। ব্রিটিশ ভারতের অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ, উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক মহানায়ক ,স্বাধীনতার বিপ্লবী চারণ কবি কাজী নজরুল ইসলামই সর্বপ্রথম সাহিত্যকে জাতীয় স্বাধীনতা ও নিপীড়িত জনতার শশাষণ মুক্তির লক্ষ্যে ব্যবহার করেছেন। আর তাই তাকে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের রােষানলে পড়তে হয়েছে এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে কারাভােগও করতে হয়েছে। কিন্তু তবু তিনি সাম্রাজ্যবাদী শাসকের কাছে মাথা নত করেননি। বরং বলেছেন-

“কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল করবে লোপাট …
কিংবা
“এ দেশ ছাড়বি কিনা বল,
নইলে কিলের চোটে হাড় কবির জল।”

বাংলা সাহিত্যে পদচারণাঃ
বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ১৯১৯ সালে । ১৮৯৯ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসােল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। কাজী নজরুল ইসলামের জন্মের পূর্বে একে একে তাঁর চারটি ভাই অকালে মারা যায় । সেজন্যে পিতামাতা তাঁর ডাকনাম রাখেন দুখু মিয়া। মাত্র ৯ বছর বয়সে ১৯০৮ সালে তিনি পিতাকে হারান। তাই সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও কিশাের বয়সেই তাকে দারিদ্র্যের সঙ্গে মােকাবেলা করতে হয়। ১৯০৯ সালে ১০ বছর বয়সে নজরুল ইসলাম গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কিছুকাল সেই মক্তবেই শিক্ষকতা করেন। সেই সঙ্গে মসজিদে আজান দিয়ে এবং মাজারে খাদেমগিরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু দামাল কিশাের নজরুলের শিল্পী মন অসীমের পানে ছুটে যেতে চায়। চুরুলিয়ার গণ্ডিবদ্ধ আঙিনায় বাধা থাকতে চায় না। চাচা বজলে করিম ফারসি ভাষায় কবিতা চর্চা করতেন। তাঁর প্রভাবে নজরুল ইসলাম বালক বয়সেই ফারসি-উর্দু মিশ্রিত মুসলমানী বাংলায় পদ্য রচনা শুরু করেন। সেকালে গ্রামাঞ্চলে ‘লেটোনাচ’ নামে এক ধরনের যাত্রাপালা অভিনীত হতাে। নজরুল সেই লেটোদলের জন্য শকুনি বধ’, ‘মেঘনাদ বধ’, ‘রাজপুত্র’ ‘চাষার সং’ প্রভৃতি গীতিনাট্য ও প্রহসন এবং বহু মারফতী, ‘পাচালি’ ও কবিগান রচনা করে সমগ্র এলাকায় খ্যাতি লাভ করেন। ফলে অন্যান্য এলাকা থেকেও লেটোদলের লােকজন তাঁর কাছে পালা লেখাতে  আসত। এতে তার কিছু রােজগারও হতাে ।

আরও দেখুন:- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী বিস্তারিত জানুন।

শিক্ষাজীবনঃ

১৯১১ সালে বালক নজরুল বর্ধমানের মাথরুন গ্রামের নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউটে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে লেখাপড়া এগােল না। আবার যােগ দিলেন বাসুদেবের কবি দলে পালা রচয়িতা হিসেবে। এখানে তিনি শুধু পালাই রচনা করতেন না, মঞ্চে ঢােলক বাজিয়ে, গান করে দর্শকদের মাতিয়ে রাখতেন। তার এমনই এক কাণ্ড দেখে মুগ্ধ হন বর্ধমানের রেলওয়ে গার্ড মি. ঘােষ । তিনি পরে বালক নজরুলকে তার বাংলােয় ডেকে পাঠান এবং মাসিক পঁচিশ টাকা বেতনে চাকরের কাজে নিযুক্ত করেন। কিন্তু নজরুল বেশিদিন এ কাজে টিকলেন না।

কর্ম-জীবনঃ

এরপর কাজ নিলেন আসানসােলের রুটির দোকানে, আটা মাখার জোগালী হিসেবে। বেতন মাসে এক টাকা এবং খাওয়া। থাকার জায়গা নেই। নিরুপায় নজরুল দোকানের পাশে ত্রিতল বাড়ির সিঁড়ির নিচে দ্ৰিাযাপন করতেন। পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর কাজী রফিকউল্লাহ থাকতেন এ বাড়িতে। কিছুদিনের মধ্যেই বালক নজরুল নিঃসন্তান কাজী দম্পতির অপরিসীম স্নেহানুকূল্য লাভ করেন। তারই সুবাদে ১৯১৪ সালের গােড়ার দিকে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে নজরুল ইসলামের ময়মনসিংহের ত্রিশালে আগমন। এখানে নজরুল ভর্তি হন দরিরামপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে। বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু দুরন্ত বালক নজরুলের শিল্পী মন যে কোথাও বেশি দিন বাঁধা থাকতে চায় না। ফলে কাউকে কিছু না জানিয়েই একদিন ত্যাগ করেন ত্রিশাল । ১৯১৫ সালে নজরুল ইসলাম শিয়ারসােল রাজ হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং দশম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে পড়াশােনা করেন। এ সময় তার কাব্যচর্চা নতুন মাত্রা পেল । লেটোদল ও কবিয়ালদের প্রভাবমুক্ত হয়ে  বালক নজরুল আধুনিক কাব্যচর্চায় মনােনিবেশ করেন এবং অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দে যথাক্রমে ‘করুণ গাঁথা’, ‘বেদনা-বেহাগ’ ও ‘চড়ুই পাখির ছানা’ প্রভৃতি কবিতা রচনা করে আধুনিক কবিতার জগতে প্রবেশ করেন।

বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণঃ

১৯১৭ সালে প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে নজরুল যােগ দেন বেঙ্গল ডবল কোম্পানিতে। এই কোম্পানি পরবর্তীকালে ৪৯ নং বাঙালি পল্টন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ সময়ে কবি পল্টনের পাঞ্জাবি মৌলবি সাহেবের কাছে ফারসি কাব্য পাঠ করে ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেন। সৈনিক জীবনে নজরুল ইসলামকে যুদ্ধ করতে যেতে হয়নি । এ সময়ে পাকিস্তান। বিশেষ করে বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রকৃতির সঙ্গে কবির প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সংযােগ স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে সাহিত্যে এসবের প্রভাব লক্ষ করা যায়। কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালে কুমিল্লার দৌলতপুর গমন করেন। সেখানে তিনি আড়াই মাস অবস্থান করেন। এ সময় কবিবন্ধু পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের বােনের মেয়ে নার্গিস আক্তার বানুর সঙ্গে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন এবং তাকে বিয়ে করেন। কিন্তু এই বিয়ে টেকেনি। বিয়ের পরদিনই কবি চলে আসেন। পরবর্তীকালে ১৯২৪ সালে কবি পুনরায় প্রেমে জড়িয়ে পড়ে বিয়ে করেন কুমিল্লার মেয়ে প্রমীলাকে। তাদের ঘরে তিনটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। প্রথম সন্তান বুলবুল শৈশবেই মারা যায়। অপর দুই ছেলে- কাজী সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ ।

আরও দেখুন:- আরিফ আজাদ পরিচিতি (বায়োগ্রাফি) : বই, ছবি, মিথ্যাচার বিস্তারিত জানুন।

সাহিত্যচর্চাঃ

প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে নজরুল ইসলাম চলে আসেন কলকাতায়। এখান থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে দেশের সেবা করার এক মহান ব্রত গ্রহণ করেন। শুরু হয় তার কবি জীবন । লিখতে থাকেন বিদ্রোহী, কামাল পাশা, আনন্দময়ীর আগমনে, রক্তাম্বরধারিণী মা-সহ অজস্র বিপ্লবাত্মক ও প্রেমের কবিতা। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’। অতঃপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘দোলন চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘পূবের হাওয়া’, ‘ফণি-মনসা’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘জিঞ্জির’, ‘চক্রবাক,
সন্ধ্যা’, বুলবুল’, ‘ ঝিঙেফুল’, ‘ভাঙার গান’, ‘বিষের বাঁশি’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ । লিখেন উপন্যাস- বাঁধন হারা’, ‘মৃত্যু ক্ষুধা’, কুহেলিকা’। গল্পগ্রন্থ- ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলিমালা’। লিখেন নাটক, প্রায় তিন হাজার গান, অনুবাদ করেন
রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ প্রভৃতি। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেন, অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’, সপ্তাহিক ‘লাঙল’, দৈনিক নবযুগ’ প্রভৃতি পত্রিকা। সম্পৃক্ত হন রাজনীতিতে, গঠন করেন শ্রমিক কৃষক স্বরাজ পার্টি এবং নির্বাচনে ঢাকা বিভাগ থেকে আইনসভার সদস্য পদপ্রার্থী হন। পরাজিত হন বিপুল ভােটের ব্যবধানে, জামানতও হয় বাজেয়াপ্ত ।

অসুস্থতাঃ

১৯৪২ সালের ৭ জুন কবি কলকাতা বেতারের এক অনুষ্ঠান রেকর্ডিংকালে এক দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আর কোনােদিন সুস্থ হননি।

নাগরিকত্ব প্রদানঃ

১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। ১৯৭৬ সালে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। সেই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের সমর
সঙ্গীত রচয়িতা কবিকে ‘আর্মি ক্রেস্ট প্রদান করে। ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ সালে কবি ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৭৭ বছরের এই দীর্ঘ জীবনে প্রকৃতপক্ষে কবি কর্মক্ষম ছিলেন মাত্র ৪২ বছর । বাকি ৩৫ বছর তিনি জীবন্ত অবস্থায় কাটান। এই ৪২ বছরের মধ্যে তাঁর প্রকৃত পরিণত রচনা কাল মাত্র ২২ বছর। এ সময়ে তাঁর ৫১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। অসুস্থ হওয়ার পরেও তার বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাই সব মিলিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের গ্রন্থ সংখ্যা ৬১টি।

উপসংহারঃ

বিদ্রোহের কবি, যৌবনের কবি, প্রেমের কবি, মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই বলেছেন যে, তিনি সকল দশের সকল কালের সকল মানুষের। তবু বাংলাদেশ সরকার কবি নজরুলকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘােষণা করে তাঁকে একান্ত আপনার করে গ্রহণ করেছেন এবং সম্মানিত করতে চেয়েছে হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে। কবি, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, গল্পকার ওঔপন্যাসিক এই অমর সাহিত্যস্রষ্টা চিরকাল বেচে থাকবেন বাংলাদেশের হৃদয়ে, বাঙালির হৃদয়ে। আমরা তাকে স্মরণ করি সশ্রদ্ধ
বিনম্র চিত্তে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button