বাংলা রচনা: পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
রচনার নামঃ পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার।
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
ভূমিকা : পরিবেশ হলাে পারিপার্শ্বিকতা।পরিবেশ মানবসভ্যতা ও সমাজ ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ পরিবেশের অনুগ্রহে লালিত-পালিত হয় পরিবেশ মানবজীবনে মুখ্য প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। ম্যাকাইভারের ভাষায়, “জীবন ও পরিবেশ ওতপ্রােতভাবে জড়িত। তাই মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য দূষণমুক্ত নির্মল পরিবেশ আবশ্যক। অথচ প্রতিদিনই আমদের সুন্দর পৃথিবীর বাসযােগ্য পরিবেশ নানা কারণে দূষিত হচ্ছে এবং ক্রমেই তা মনুষ্য বসবাসের অযােগ্য হয়ে পড়ছে।
পরিবেশ ও পরিবেশ দূষণ : মানুষ তথা জীবজগতের বাসযােগ্য এলাকাই হলাে তার
পরিবেশ। পরিবেশ শব্দটির পরিধি খুবই ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিষয়বস্তুগতভাবে কিবা অর্থগতভাবে পরিবেশের একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া অত্যন্ত জটিল। তবে পরিবেশ শব্দটির ভাবার্থের আলােকে বলা যায় যে, পার্থিব জলবায়ু, আবহাওয়া ও ভূ-প্রকৃতিগত জৈব ও ভৌত উপাদানসমূহের যৌথ প্রভাব ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে পরিবেশ বলে। পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে মানুষ এবং অপরাপর উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বিকাশ ঘটে। জীবজগৎ ও তার পরিবেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত জীবন রক্ষাকারী উপকরণের আদান-প্রদান চলে। এ আদান-প্রদানের ভারসাম্যের উপর জীবের অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।
পরিবেশ দূষণের কারণ : পরিবেশ দূষণের জন্য প্রধানত মানুষই দায়ী। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে ব্যবহৃত সকল দ্রব্য ও কর্মকাণ্ড, যা স্বাভাবিক জীবনযাপন বিঘ্নিত করে সেগুলােকেই পরিবেশ দূষণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট তথা পরিবেশ দূষণের নানাবিধ কারণ রয়েছে। যেমন- ব্যাপক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশের জন্য এক মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে লােকালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়।
পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও অভাব-অনটন পরিবারকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থাকে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বনজ সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশের মােট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়ােজন। সে তুলনায় পৃথিবীর অনেক দেশে বনভূমির পরিমাণ খুবই কম। তাছাড়া নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে এই বনভূমির পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই দেখা দেবে মহাবিপর্যয়, ধ্বংস হবে দেশ ও জাতির অস্তিত্ব। বর্তমানে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
কলকারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে। তা ছাড়া মানুষের নানা কার্যাবলি বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণের সৃষ্টি করে পরিবেশকে দূষিত করছে। এভাবেই বিপন্ন হচ্ছে আমাদের পরিবেশ।
গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া : বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রার পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট্প্রকৃতিগত এবং পরিবেশগত বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে বলা হয় গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া। গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিরাট হুমকির সম্মুখীন। গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার দরুন পৃথিবীতে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে মেরু অঞ্চলে বরফগলার পরিমাণ বাড়বে। মুদ্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপকূলবর্তী ও নিম্নাঞ্চল বা সাগরের দ্বীপাঞ্চলগুলাে তলিয়ে যাবে।
আরও দেখুন:- ভাব সম্প্রসারণ: দুর্নীতি জাতির সকল উন্নতির অন্তরায়।
পরিবেশ দূষণ ও বাংলাদেশ : অগণিত সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলাে পরিবেশ দূষণ। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ এমন এক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌছেছে যে,আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বিভিন্ন যন্ত্র ও গাড়িঘােড়ার বিরূপ প্রভাব, রাসায়নিক সার ও
কীটনাশকের ব্যবহার, নির্বিচারে বন উজাড়, বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার
ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণ সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশের বিশেষ করে শহরাঞ্চলে রাস্তাঘাটে বর্ধিত এবং মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলাচলের ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া বাতাসকে ভারী করে তুলছে। এসব যানবাহনের বিকট শব্দে জনজীবন অতিষ্ঠ হবার উপক্রম। পরিবেশ দূষণের কারণে বিভিন্ন ধরনের রােগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়া পরিবেশ দূষণের চরম বহিঃপ্রকাশ হলাে আর্সেনিক সমস্যা। প্রতি বছর আমাদের দেশে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, তার মূলেও রয়েছে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত সমস্যা। এদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে বনভূমি না থাকায় বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি
ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হচ্ছে। দেশে মরুময়তা দেখা দিচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে ইতােমধ্যেই মরুময়তার আবির্ভাব ঘটেছে।
পরিবেশ দূষণের প্রতিকার : পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে মানুষের সামগ্রি যে সব ক্ষতি সাধিত হয় তা থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের অবশ্যই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পথ বের করতে হবে। এর জন্য নানা পদ্ধতি প্রয়ােগ করা যেতে পারে। বায়ুদূষণের বেলায় কীট নিধনে জৈব নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ, নিবিড় বনায়ন, রাসায়নিক পদার্থের শােধন, ধোয়ার পরিশুতিকরণ, বসতি ও শিল্পাঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব রাখা ইত্যাদি ব্যবস্থা গৃহীত হতে পারে। পানি দূষণ দূর করার জন্য রাসায়নিক পদার্থ ও ময়লার
বিশােধন দরকার। শব্দ দূষণ দূর করতে ত হলে শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং সুনাগরিকতার বিকাশ ঘটাতে হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণে গৃহীত পদক্ষেপ :
বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ রক্ষার্থে এবং
আগামী প্রজন্মকে পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা করতে কতিপয় যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ
করেছে। যেমন পলিথিন বিভিন্নভাবে সার্বিক পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলেছিল। শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও স্যুয়ারেজ লাইন অচল করে দিয়েছিল এটি। এই অসহনীয় অবস্থা থেকে
পরিত্রাণের জন্য পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। সরকার ১ মার্চ, ২০০২ থেকে সারাদেশে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে। সরকার পরিবেশ দূষণমুক্ত করা ও যানজট নিরসনের লক্ষ্যে ২৫ বছরের বেশি পুরােনাে ট্রাক ও ২০ বছরের বেশি পুরােনাে বাস, মিনিবাস চলাচল নিষিদ্ধ করেছে।
পুরােনাে সকল বেবিট্যাক্সি, টেম্পাে ও অটোরিকশা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব টু-
স্টোক যানবাহনের নির্গত ধোঁয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইড, সিসা, কার্বন মনােক্সাইডসহ
ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষষ্মিন্ত করছিল। এ ছাড়া
পরিবেশ দূষণ রােধে যানবাহনে সিএনজি জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানাে হচ্ছে। এ লক্ষ্যে
দেশের নানা প্রান্তে সিএনজি স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। দেশকে অধিকতর বাসযােগ্য করে তােলার লক্ষ্যে সরকার আরও যেসব পদক্ষেপ
গ্রহণ করেছে তন্মধ্যে রয়েছে পরিবেশ আদালত স্থাপন। এ আদালতে পরিবেশ দূষণজনিত
সকল অপরাধের দ্রুত বিচার সম্পন্ন হবে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীসহ ৬টি
বিভাগীয় শহরে পরিবেশ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঢাকায় ‘কন্টিনিউয়াস এয়ার মনিটরিং স্টেশন
(সিএএমএস) নামক বায়ুদূষণ পরিমাপক যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। এ যন্ত্রের মাধ্যমে বায়ুদূষণের মাত্রা জানা যাবে এবং যথাসময়ে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রধান উপায় জলাভূমি রক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে গুলশান, বারিধারা লেক এবং আশুলিয়ায় সরকার সময়ােপযােগী ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় কাটা বন্ধে উল্লেখযােগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ইটের ভাটায় কাঠ ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে এবং ভাটা থেকে উদৃগীরিত ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর
ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বুড়িগঙ্গাসহ সারা দেশে নদী দূষণ বন্ধ করার জন্য নেয়া হয়েছেকার্যকর পদক্ষেপ।
উপসংহার : পরিবেশ দূষণ পরিবেশের ভারসাম্য তথা মানব জাতির জন্য এক মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ ব্যাপারে সারা বিশ্বের মানুষের সচেতনতা প্রয়ােজন। আমাদের মতাে উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যা আরও প্রকট। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তথা অস্তিত্ব রক্ষার
প্রশ্নে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা একান্ত অপরিহার্য।