রচনা

রচনা: বৃক্ষরােপণ/বৃক্ষরােপণ অভিযান (+PDF)

রচনার নামঃ বৃক্ষরােপণ অভিযান।

ভূমিকা : “দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।”-কবির এ আবেদন অরণ্য সৃষ্টির জন্য। কারণ অরণ্য জীবনের মতােই প্রয়ােজনীয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা বিশ্বকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কবল থেকে বাঁচাতে বর্তমানে বৃক্ষরােপণ জীবন বাঁচানাের মতােই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলাের তুলনায় বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ নৈরাশ্যজনকভাবে কম হওয়ায় এ দেশ অগণিতসমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এ সব সমস্যা
থেকে উত্তরণের জন্য অধিক হারে বৃক্ষরােপণ করতে হবে।

বৃক্ষরােপণ কী : দেশের প্রাকৃতিক বন ব্যতিরেকে বৃক্ষের উৎপাদন বৃদ্মি লক্ষ্যে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে বসতবাড়ি, রাস্তা, বাঁধ, খাস ও প্রাতিষ্ঠানিক জমিতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাপকভিত্তিক গাছ লাগানাে, পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে বৃক্ষরােপণ বলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বন দিনে দিনে কমছে। ক্রমহ্রাসমান এ প্রাকৃতিক বন আমাদের আর্থ-সামাজিক সর্বোপরি প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করেছে তা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাপকভাবে বৃক্ষরােপণ করা
উচিত।

বাংলাদেশে বনাঞ্চলের বর্তমান অবস্থা : পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, কোনাে দেশের কাম্য পরিবেশের জন্য সে দেশের মােট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়ােজন। কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় বাংলাদেশে বনভূমি খুবই কম। এখানে ৫৫,০০০ বর্গমাইল এলাকায় মাত্র ১০,০০০ বর্গমাইল বনভূমি রয়েছে, যা দেশের মােট আয়তনের মাত্র ১৭ ভাগ।

বৃক্ষ হ্রাসের কারণ : এককালে এদেশের বনমর্মরে কূজিত হতাে বিহগকণ্ঠ। এখানে ছিল ফলবান বৃক্ষের বাগানে শ্যামল শােভা, ছিল অরণ্যে বিপুল বৃক্ষরাজি। কিন্তু আধুনিক জীবন ও সভ্যতার গ্রাসে সবুজ বাংলার সেই শ্যামল সুন্দর রূপ আজ তিরােহিত। বিভিন্ন প্রয়ােজনে-অপ্রয়ােজনে নির্বিচারে প্রতিনিয়ত কাটা হচ্ছে বৃক্ষ। ক্রমবর্ধমান বিপুল জনসংখ্যার আবাসলের প্রয়ােজনে বন কেটে উজাড় করা হচ্ছে। ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে চাষাবাদ সম্প্রসারণ, জ্বালানির চাহিদা মেটানাে এবং বিভিন্ন নির্মাণ কাজে ব্যবহার, ্আসবাবপত্র তৈরি ইত্যাদির জন্য প্রতিনিয়ত বৃক্ষনিধন করা হচ্ছে। তা ছাড়া ঝড়-ঝঞা, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিক সংখ্যক বৃক্ষ বিনষ্ট হচ্ছে। ভূমিক্ষয়ে নষ্ট হচ্ছে বনভূমি। বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় অনুপ্রবেশকারীর কার্যাবলি
বেড়ে গিয়ে বন ধ্বংস হচ্ছে। বন সংরক্ষণ আইনে ফাক থাকা ও যথাযথ প্রয়ােগ না হওয়াও বন ধ্বংস তথা বৃক্ষ হ্রাসের অন্যতম কারণ।

আরও দেখুন:- অ্যালোভেরার উপকারিতা ও অপকারিতা জানুন

পরিবেশের ওপর বৃক্ষ হ্রাসের প্রভাব : বৃক্ষহীনতা যে কোনাে দেশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে। বনভূমির অভাবে অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলােচ্ছাস দেখা দেয়। বায়ুমণ্ডল। ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে। দেশ আস্তে আস্তে মরুভূমিতে পরিণত হয়। দেশের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। দেশ বন্যপ্রাণী ও বন্যপাখি শূন্য হয়ে যায়। ফলে মানবজীবন নানা সংকটের সম্মুখীন হয়। বৃক্ষ হ্রাসের ফলে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পায়  ও মৃত্তিকার উর্বরতা কমতে থাকে। পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে চলে যাওয়া এবং নদীর পানি বৃদ্ধি ও গতি প্রবাহ পরিবর্তনে পলি পতন বৃদ্ধি ক্রমাগত বৃক্ষ হ্রাসের ফল। পর্যাপ্ত গাছ না থাকলে বায়ু প্রবাহের অনিয়ন্ত্রিত গতির ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। বৃক্ষ হ্রাসের ফলে বায়ুমণ্ডলে জলীয়বারে পরিমাণ বেড় আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতা বৃদ্ধি পায়। বৃক্ষ হ্রাস পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করে ও গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার মতাে বিভিন্ন মারাত্মক প্রাকৃতিক সমস্যা সৃষ্টি করে।

বৃক্ষরােপণের প্রয়ােজনীয়তা : বৃক্ষের প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম। বিভিন্ন জৈবিক
ক্রিয়ার মাধ্যমে অনাদিকাল থেকে বৃক্ষরাজি প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং পরিবেশ দূষণ থেকে
আমাদেরকে রক্ষা করে আসছে। বৃক্ষ বাতাসের অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড শােষণ করে
এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। এতে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের ভারসাম্য
রক্ষা পায়। বৃক্ষ শিকড়ের মাধ্যমে মাটিকে আটকে রেখে ভূমিক্ষয় রােধে সাহায্য করে,
ভূ-গর্ভস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি করে এবং নদ-নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া বৃক্ষ উচ্চ তরঙ্গবিশিষ্ট শব্দকে শােষণ করে শব্দ দূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে। বন্য জীবজন্তু, পাখি ও কীটপতঙ্গাকে আশ্রয় দেয় ও খাদ্য যােগায় বৃক্ষরাজি। প্রয়ােজনীয় ও পর্যাপ্ত বৃক্ষ ঝড়, জলােচ্ছাস, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জনপদ রক্ষা করে। বৃক্ষ মানুষকে খাদ্য ও পুষ্টি যােগায়, গৃহ ও অন্যান্য নির্মাণ কাজে কাঠের যােগান দেয়। মানুষকে আর্থিক সংকট থেকে রক্ষা করে বৃক্ষ। বৃক্ষ ছায়া দেয়, জীবনরক্ষাকারী
অক্সিজেন দেয়, ওষুধ দেয় এবং জ্বালানি দেয়। বৃক্ষ থেকে কাগজের মণ্ড এবং রেয়ন শিল্পের কাঁচামাল ও দিয়াশলাই তৈরি হয়। বৃক্ষ থেকে ধুনা, লাক্ষা, গদ, কর, তারপিন তেল ও রাবার পাওয়া যায়। বনাঞ্চলে ফল-ফুল, মধু ও মােম পাওয়া যায়। এক কথায় মানুষ ও প্রাণীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃক্ষের প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম।

বৃক্ষরোপণ অভিযান : পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে মানুষের যে সব ক্ষতি
সাধিত হয় তা থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের অবশ্যই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পথ বের করতে হবে। এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন নিবিড় বনায়ন। এ লক্ষ্যেই দেশে। প্রতি বছর পালিত হচ্ছে বৃক্ষরােপণ অভিযান’।

বৃক্ষরােপণে গৃহীত পদক্ষেপ : গত একশাে বছরে বনাঞ্চল ব্যাপকভাবে উজাড় হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ যে ব্যাপক ক্ষতির মুখােমুখি হয়েছে তা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পুরণের প্রচেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে কমিউনিটি বনায়ন কর্মসূচির আওতায় বারাে হাজার একর জ্বালানি কাঠের বাগান, তিনশাে একর বন-বাগান, তিন হাজার একর স্ট্রিপ-বাগান স্থাপন উল্লেখযােগ্য। ৭ হাজার গ্রামকে এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। বনায়ন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি জন্যে ৮০ হাজার ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং জনসাধারণের মধ্যে ৬ কোটি চারা বিতরণ করা
হয়। এভাবে ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। উপকূলীয় চরাঞ্চলে, সবকটি মহাসড়কের দুপাশে, রেলসড়কের উভয় ধারে এবং বাঁধ এলাকায় বনায়নে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়।

বৃক্ষরােপণ অভিযান সফল করার উপায় : বৃক্ষরােপণ অভিযানকে সফল করতে হলে
সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশের ষােল কোটি
লােকের প্রত্যেকে যদি কমপক্ষে একটা করে বৃক্ষ রােপণ করি, তাহলে সহসাই আমাদের এ অভিযান সফল হবে। মােটকথা, বৃক্ষ রােপণকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে
পারলে এ থেকে সর্বতােভাবে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। সমাজে বসবাসরত মানুষকে
যদি বিপন্ন পরিবেশের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করা যায়, তাহলে অনেকেই বনায়নের
কাজে এগিয়ে আসবে। তাছাড়া চারা উৎপাদন করে বিনামূল্যে তা জনগণের মাঝে সরাহ করে বৃক্ষ রােপণের জন্য জনমনে চেতনা সঞ্চার করতে হবে। এ ব্যাপারে রেডিও, টেলিভিশন, মিনিপর্দা, মাইকে প্রচার, পােস্টার বিলি এবং সভা-সমিতি ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রয়ােজনে বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উদ্বুদ্ধকরণ কাজে অংশ নিয়ে সাধারণ মানুষকে বােঝাবেন এবং বনায়নে উৎসাহিত করবেন।

উপসংহার : মানুষ তথা সামগ্রিক পরিবেশের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বৃক্ষরােপণ অভিযান একটি বিরাট পদক্ষেপ। একটি পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও বাসােপযােগী পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অরণ্যের ভূমিকা অপরিসীম। তাই আসুন, বৃক্ষরােপণ অভিযানের মাধ্যমে আমরা লাগাই বৃক্ষ, তাড়াই দুঃখ, বঁাচাই পরিবেশ এবং দেশকে করি সমৃদ্ধ।

আরও দেখতে ক্লিক করুন:-  👎রচনা: মানব কল্যাণে বিজ্ঞান/প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান(২০পয়েন্ট)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button